“ঈশ্বর অতীত পাল্টাতে না পারলেও ইতিহাসবিদরা পারেন।” স্যামুয়েল বাটলারের এই বিখ্যাত উক্তি যেন কিছুটা ইতিহাসবিদদের অপরিপক্কতাকেই নির্দেশ করে। আবার হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে একরাশ কুৎসা।” খুব একটা ভুল বলেননি হুমায়ুন আজাদ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে জয় পরাজয়ের গল্প থাকলেও, ইতিহাসবিদরা পরাজয়ের গল্পগুলো লিখতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। কেননা পরাজয়ের গল্পের পাঠকের সংখ্যা নিতান্তই কম। মাঝি, কৃষক, মুচি, কামার,কুমোর এবং মেটেদের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় কখনও স্থান পায় না। তাই টেড কোপেল বলেছেন, “রাজনীতিবিদরা তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার জন্য যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেন তা হচ্ছে ইতিহাস।” রাজনীতির খেলায় যারা বিজয় অর্জন করে কেবল শুধুমাত্র তারাই তাদের গল্পগুলোকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। পরাজিত দলের করুন রস সেখানে তুচ্ছ।

 

জঙ্গি শব্দটি কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর সুবাদে বেশ পরিচিত। জঙ্গি শব্দটি ফার্সি ‘জঙ্গ’ শব্দ থেকে এসেছে। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ আর জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা। সুতরাং ফার্সি ভাষায় এর অর্থ দাড়ায় লড়াকু অথবা যোদ্ধা। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো জঙ্গি শব্দটি শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথেই যুক্ত করে দিয়েছেন। তাদের তথাকথিত ধ্যান ধারণা -দাঁড়ি,আলখেল্লা কিংবা পাগরী পরিহিত মানুষগুলোই জঙ্গির সাথে জড়িত। পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াগুলো জঙ্গিদের কিছু কিছু নিন্দনীয় কাজের তালিকা প্রকাশ করেছেন। যেমন- গনহত্যা, যৌনাচার, অস্ত্রব্যবসা, সাধারণ শিক্ষা প্রত্যাহার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংক্ষিপ্তকরণ ইত্যাদি। অবশ্যই এগুলো নিন্দনীয় কাজ। তবে এই কাজগুলো কি শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথেই যুক্ত? অবশ্যই নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ, মায়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যা, ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উপর নির্বিচারে গনহত্যা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।

 

গত কয়েকদিন থেকে পত্র- পত্রিকায় চোখে পড়বার মতো একটি বিষয় – “সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান যোদ্ধারা কাবুল দখল করেছে।” সংবাদটি অবাক করবার মতো।

আফগান গৃহযুদ্ধের সময় অন্যতম দল হিসেবে ১৯৯৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে তালেবান। নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ উমর। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নেয় তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠী। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির কাছে হেরে যায় তালেবান। আমেরিকা এবং ন্যাটো দেশগুলো কর্তৃক ২০০১ সালে আফগানিস্তানে এক যৌথ অভিযান চালায়। এই অভিযানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে। তালেবানদের অবসানের কয়েকদিনের মাঝেই জঙ্গি শব্দটি সারা বিশ্বে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। তালেবানরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। আবার তালেবানদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইসলামকে মূল্যায়ণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভাববার বিষয়। অথচ তালেবানদের সাথে ইসলাম শব্দটি জুড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।

 

আল কায়েদার ঘাঁটি মিশিয়ে দিতে এসে মার্কিন সেনারা আর ফিরে যায়নি। একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ কতোটা নিন্দনীয় তা বিশ্ব মাতব্বরদের কোনদিনই চোখে পড়েনি। আফগানরা নিজ দেশেও যে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলো পশ্চিমা মিডিয়াগুলো তা কোনদিন তুলে ধরেনি। তালেবানরা পরাজিত হওয়ার পর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার জন্য যে কর্মকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছেন তা মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়। হঠাৎ আক্রমণের সম্ভাবনা আফগানিস্তানিদের ভাবিয়ে তুলতো। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তালেবানরা যতবার জয়ের পথে হেঁটেছে, ততবারই পশ্চিমা মিডিয়া কিংবা বিশ্ব মাতব্বরেরা জঙ্গি হামলা বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু গত কয়েকদিনের চিত্রটা একবারে ব্যতিক্রম। তালেবানদের সঙ্গে জঙ্গি শব্দটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। তালেবানরা এখন যোদ্ধা। চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান তালেবানদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিবৃতি দিয়েছে। জো বাইডেন বলেছেন, ” আফগানিস্তানে শান্তি বজায় রাখতেই সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা।”

ইতিমধ্যে রাজনীতির নীল নকশায় ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বিজয়ীদের হাতে লিখিত ইতিহাস -পরাজিতদের আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহ দেয়। ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ২০ বছরে তালেবানরা গোপনেই শক্তির সঞ্চয় করতে থাকে। তবে এটা ভেবেও খুব একটা খুশি হবার কারণ নেই যে, তালেবানের হাতে মার্কিনের পরাজয়। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, মাঝে মাঝে জয়ের আনন্দটাকে দীর্ঘ করবার জন্য নিজেকে কখনও পিছিয়ে নিতে হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো তাই করছেন।

 

লেখক –

শিক্ষার্থী, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।